অনলাইন এডুকেশন ও বাংলাদেশ

অনলাইন এডুকেশন ও বাংলাদেশ

শিক্ষা ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকেই ঝুকছেন অনলাইন এডুকেশন সিস্টেমের দিকে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কতটা কার্যকরী এই অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম? বাংলাদেশ কি প্রস্তুত এই সিস্টেম গ্রহণ করতে? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব আজকের আর্টিকেলে।

কী এবং কিভাবে কাজ করে?

অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম হলো ইন্টারনেট ভিত্তিক এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষার্থীরা সরাসরি অর্থাৎ লাইভ ক্লাস বা রেকর্ডেড ভিডিও, ই-বুক, ইন্টারেকটিভ কুইজ ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করে।

অনলাইন এডুকেশন প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এবং ইন্টারেকটিভ মাধ্যমের মিশ্রণ যা শিখন প্রক্রিয়াকে সহজ করেছে। অনলাইন এডুকেশন তিনটি প্রধান ধাপে কাজ করেঃ

  • প্লাটফর্ম ও কোর্স নির্বাচনঃ প্রথমেই একজন শিক্ষার্থীকে যেকোন একটি প্লাটফর্ম থেকে তার পছন্দের কোর্স নির্বাচন করতে হয়। প্রতিটি কোর্সের নির্দিষ্ট একটি শিডুইল থাকে।
  • ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির সংযোগঃ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়েই ইন্টারনেট ব্যবহার করে একটি ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে যুক্ত হন। লাইভ ক্লাস বা সেশন চলাকালীন বিভিন্ন ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যার যেমনঃ যুম, গুগোল ক্লাসরুম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
  • ইন্টারেকটিভ কন্টেন্ট এবং যোগাযোগঃ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে যোগাযোগ হয় লাইভ চ্যাট, অডিও-ভিডিও কলে বা ইমেইলের মাধ্যমে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয় এবং শিক্ষকরা তা মূল্যায়ন করেন। কুইজ, গেম এবং সিমুলেশনের মাধ্যমে শিক্ষার অভিজ্ঞতা আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়।

যাত্রা ও উত্থান

অনলাইন এডুকেশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির সাথে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এর উত্থানের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধাপ। ১৯৬০-১৯৭০ দশক অনলাইন শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন হয়। ২০০০-এর দশক ইন্টারনেটের প্রসার এবং ব্রডব্যান্ড সংযোগের সহজলভ্যতার ফলে অনলাইন শিক্ষা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০২০-এর পর কোভিড-১৯ মহামারিতে অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম একটি অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি পায়।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। তবে এর কার্যকারিতা ও বিস্তারে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ।

  • ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎঃ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত এবং গতি অনেক কম। ব্রডব্যান্ড সংযোগের উচ্চ খরচ। প্রায়ই লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার সমস্যা।
  • ডিভাইসের অভাবঃ অনেক শিক্ষার্থীর কাছে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার নেই। পরিবারপ্রতি একটি ডিভাইস থাকলেও, একাধিক শিক্ষার্থীর জন্য তা পর্যাপ্ত নয়।
  • দক্ষতার অভাবঃ অনেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়। শিক্ষকদের মধ্যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পড়ানোর দক্ষতা সীমিত।
  • পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নঃ শিক্ষার্থীদের প্রগতি ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা কঠিন।পরীক্ষার সময় নকল বা প্রতারণা রোধ করা চ্যালেঞ্জিং।

চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, অনলাইন এডুকেশন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা, এবং সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলোকে কাটিয়ে তোলা সম্ভব।

  • শিক্ষার সহজলভ্যতাঃ যে কেউ যেকোনো সময় এবং যেকোনো স্থান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। দূরবর্তী এলাকাগুলোর শিক্ষার্থীরা উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে।
  • খরচ সাশ্রয়ঃ অনলাইন শিক্ষার খরচ প্রচলিত শিক্ষার তুলনায় অনেক কম। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই এবং উপকরণ ইলেকট্রনিক ফর্মে পাওয়া যায়।
  • দক্ষতা বৃদ্ধিঃ শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে প্রযুক্তি ব্যবহারে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতের চাকরি বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য ডিজিটাল দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ।
  • আন্তর্জাতিক মানঃ Coursera, Udemy, Khan Academy ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের কোর্স করতে পারে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ঘরে বসে সম্পন্ন করা সম্ভব।
  • মহামারী বা দুর্যোগের সময় শিক্ষার ধারাবাহিকতাঃ কোভিড-১৯-এর মতো মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখা সম্ভব।

ক্যারিয়ার অপুরচুনিটি

অনলাইন এডুকেশন শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, কর্মসংস্থান এবং ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রেও বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে আপনি দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে পারেন। এ বিষয়ে আর একদিন বিস্তারিত আলোচনা করব।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করে গত চার-পাঁচ বছর আগে। প্রতিনিয়ত আত্মপ্রকাশ করছে নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান। নিচে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শর্ট ডেস্ক্রিপশন দেওয়া হলো।

  • টেন মিনিট স্কুলঃ আয়মান সাদিক প্রতিষ্ঠিত টেন মিনিট স্কুল বর্তমানে টপ অনলাইন এডুকেশন প্লাটফর্মের একটি। এখানে ফ্রি ও পেইড উভয় ধরনেরই কোর্স আছে। সাধারণত একাডেমীক কোর্স নিয়ে বেশি কাজ করে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। টেন মিনিট স্কুল অনলাইন পোর্টাল
  • ওস্তাদঃ প্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন লাইভ কোর্স পরিচালনা করে থাকে ওস্তাদ। এই প্রতিষ্ঠান ব্যাচ আকারে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং সহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ওস্তাদ অনলাইন পোর্টাল
  • ইউল্যাবঃ জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতায়নের লক্ষ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইউল্যাব। লাইভ ও রেকর্ডেট উভয় পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ইউল্যাব। ইউল্যাব অনলাইন পোর্টাল
  • শিখোঃ একাডেমীক ও এডমিশন প্রোগ্রামের কোর্স পরিচালনা করে থাকে শিখো। এরা ব্রাঞ্চ ভিত্তিক বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমেও অফলাইনে শিক্ষা প্রদান করে। শিখো অনলাইন পোর্টাল
  • বহুব্রীহিঃ রেকর্ডেট কোর্স সেল করে থাকে বহুব্রীহি। দামের সাথে মানের সামাঞ্জস্য রাখতে কিছু কিছু কোর্সের দাম একটু বেশি মনে হতে পারে। বহুব্রীহি অনলাইন পোর্টাল

অদূর ভবিষ্যতে অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম জায়ান্ট আকার ধারণ করবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গুলো আরো উন্নত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদেরও আগ্রহ বাড়ছে। তবে মনে রাখতে হবে অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম কখনই প্রচলিত পদ্ধতির বিকল্প নয়, তবে সহায়ক। অনলাইন এডুকেশন বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার এবং সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে।

কমেন্ট করুন