ওয়ার্ম ভাইরাসের সংজ্ঞা
কম্পিউটার ওয়ার্ম ভাইরাস একটি ক্ষতিকারক প্রোগ্রাম, যা নিজেই নিজেকে কপি করে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কম্পিউটার ওয়ার্ম ভাইরাস সাধারণত সিকিউরিটি সফটওয়্যার বা সিস্টেমের দুর্বলতাগুলো কাজে লাগায় এবং সংবেদনশীল তথ্য চুরি করে, সিস্টেমে প্রবেশের জন্য ব্যাকডোর ইনস্টল করে, ফাইল নষ্ট করে বা অন্য ধরনের ক্ষতি করে।
ওয়ার্ম অনেক মেমোরি ও ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে, যার ফলে সার্ভার, সিস্টেম এবং নেটওয়ার্কগুলো অতিরিক্ত লোডে ভুগে থাকে। ভাইরাস থেকে ভিন্ন, ওয়ার্ম নিজের কর্মের জন্য অন্য কোনো প্রোগ্রামের ওপর নির্ভর করে না।
ওয়ার্মের ধরন ও নাম
কম্পিউটার ওয়ার্ম ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন রয়েছে, যা বিভিন্ন উপায়ে ছড়ায় এবং আক্রমণ করে। এখানে ওয়ার্ম ভাইরাসের প্রধান কয়েকটি ধরন ও তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো:
ইমেইল-ওয়ার্ম
ইমেইল-ওয়ার্ম একটি ওয়ার্ম যা ইমেইলের সংযুক্ত ফাইল (attachment) বা লিঙ্কের মাধ্যমে ছড়ায়। এ ধরনের ওয়ার্ম ব্যবহারকারীর অজান্তেই ইমেইল ঠিকানার তালিকা থেকে অন্য ব্যবহারকারীদের কাছে কপি করে পাঠায়। অনেক ক্ষেত্রে এটি এমন একটি বিষয়বস্তু নিয়ে আসে যা দেখতে আকর্ষণীয় বা জরুরি মনে হয়, যেমন কোনো চমকপ্রদ খবর বা জরুরি সতর্কবার্তা।
উদাহরণ: ২০০০ সালে ছড়িয়ে পড়া ‘আই লাভ ইউ’ (ILOVEYOU) ওয়ার্ম ছিল একটি ইমেইল-ওয়ার্ম। এটি একটি ইমেইল সংযুক্তি হিসেবে এসেছিল এবং ব্যবহারকারীরা এটিতে ক্লিক করলে ওয়ার্মটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের পরিচিতদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এটি লক্ষাধিক কম্পিউটারকে সংক্রমিত করেছিল।
আইএম-ওয়ার্ম
আইএম-ওয়ার্ম (Instant Messenger Worm) ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মাধ্যমে ছড়ায়। এই ধরনের ওয়ার্ম ব্যবহারকারীর মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনের ঠিকানা বইটি স্ক্যান করে এবং নিজেকে কপি করে সকল পরিচিতির কাছে পাঠায়। এটি বেশিরভাগ সময়ে বন্ধু বা পরিচিতদের কাছ থেকে আসা বার্তা মনে হয়, যা ব্যবহারকারীকে লিংকে ক্লিক করাতে প্রলুব্ধ করে।
উদাহরণ: ২০০৫ সালে ‘হ্যালো’ (Hello) ওয়ার্মটি এমএসএন (MSN) ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে ছড়িয়েছিল। এটি একটি ‘হ্যালো’ মেসেজ পাঠাতো এবং মেসেজটি খুললেই এটি দ্রুত সংক্রামিত হয়ে অন্যান্য ব্যবহারকারীদের কাছে ছড়িয়ে পড়ত।
আইআরসি-ওয়ার্ম
আইআরসি-ওয়ার্ম (Internet Relay Chat Worm) ওয়ার্মটি আইআরসি চ্যাট নেটওয়ার্কে ছড়ায়। এটি সংক্রামিত ডিভাইসে একটি স্ক্রিপ্ট ইনস্টল করে এবং আইআরসি চ্যানেল ব্যবহারকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এই ওয়ার্ম সাধারণত একটি ‘বট’ হিসেবে কাজ করে এবং হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে থাকা চ্যাট সেশনগুলোতে সংক্রামিত মেশিনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
উদাহরণ: ২০০২ সালে ‘ডব্লিউ৩২.লাভগেট’ (W32.Lovegate) নামে একটি আইআরসি-ওয়ার্ম ছড়িয়েছিল। এটি চ্যাট রুমে স্ক্রিপ্ট চালু করে এবং সংক্রামিত ডিভাইসগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে হ্যাকারদের কাছে পাঠাতো।
নেট-ওয়ার্ম
নেট-ওয়ার্ম (Net-Worm) এমন এক ধরনের ওয়ার্ম যা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। এটি নেটওয়ার্ক শেয়ারগুলোর মাধ্যমে ছড়ায়, যা সাধারণত লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (LAN) ব্যবহারকারী একাধিক ডিভাইসে ছড়িয়ে পড়ার জন্য ব্যবহার করে। নেট-ওয়ার্ম অনেক সময়ে নিজেকে একবার চালু করে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক শেয়ারের মাধ্যমে দ্রুত ছড়ায়।
উদাহরণ: ‘ব্লাস্টার’ (Blaster) বা ‘লাভস্যান’ (Lovesan) নামের একটি নেট-ওয়ার্ম ২০০৩ সালে ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। এটি উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের নিরাপত্তা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষাধিক কম্পিউটারে সংক্রমিত হয়েছিল এবং বেশ কয়েকটি সংস্থার কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।
পি২পি-ওয়ার্ম
পিয়ার-টু-পিয়ার (P2P) ওয়ার্ম পি২পি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায়, যেখানে ব্যবহারকারীরা ফাইল শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত ফাইল আদান-প্রদান করেন। এই ধরনের ওয়ার্ম ব্যবহারকারীর অজান্তেই তার ডিভাইসের মাধ্যমে অন্যদের কাছে সংক্রমিত ফাইল শেয়ার করে।
উদাহরণ: ২০০১ সালে ছড়িয়ে পড়া ‘ওয়েলচিয়া’ (Welchia) ওয়ার্ম ছিল একটি পি২পি-ওয়ার্ম। এটি ব্যবহারকারীদের পি২পি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংক্রমিত করত এবং উইন্ডোজের অনেক ডিভাইসের ক্ষতি করেছিল।
এই ওয়ার্মগুলো শুধুমাত্র ব্যবহারকারীর ডিভাইসে ক্ষতি সাধনই করে না, বরং এর মাধ্যমে সংবেদনশীল তথ্য চুরি, ব্যাকডোর ইনস্টলেশন এবং সিস্টেমকে অকার্যকর করতেও সক্ষম। বিভিন্ন সময়ে বড় বড় ওয়ার্ম আক্রমণের ঘটনাগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি, এর দ্বারা ব্যক্তিগত ও পেশাগত ক্ষতি উভয়ই হতে পারে।
কিভাবে ওয়ার্ম ভাইরাস বা কম্পিউটার ওয়ার্ম কাজ করে এবং ছড়ায়
ওয়ার্ম সাধারণত সফটওয়্যারের দুর্বলতাগুলো কাজে লাগিয়ে, ইমেইল সংযুক্তি, ইনস্ট্যান্ট মেসেজ, বা স্প্যাম ইমেইলের মাধ্যমে কম্পিউটারে প্রবেশ করে। একবার ডিভাইসে প্রবেশ করলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়। ওয়ার্ম ফাইল মুছতে, পরিবর্তন করতে এবং আরও ক্ষতিকারক সফটওয়্যার ইনস্টল করতে পারে। অনেক সময় ওয়ার্মের মূল উদ্দেশ্য নিজেকে বারবার কপি করে সিস্টেমের মেমোরি বা হার্ড ড্রাইভের স্থান নষ্ট করা।
কিভাবে ওয়ার্ম ছড়ায়:
- ইমেইল সংযুক্তির মাধ্যমে
- ওয়েবসাইট বা FTP লিঙ্কের মাধ্যমে
- ICQ বা IRC মেসেজের মাধ্যমে
- নেটওয়ার্ক প্যাকেটের মাধ্যমে
- পিয়ার-টু-পিয়ার (P2P) ফাইল-শেয়ারিং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে
কিভাবে বুঝবেন আপনার কম্পিউটারে ওয়ার্ম আছে কিনা
- গতি ও কর্মক্ষমতা মনিটর করুন: কম্পিউটার ধীরগতিতে চলছে কিনা বা কিছু প্রোগ্রাম ঠিকমত কাজ করছে না কি, দেখুন।
- নতুন বা হারানো ফাইলের দিকে নজর রাখুন: নতুন অজানা ফাইলের উপস্থিতি বা হারানো ফাইল দেখলে সাবধান থাকুন।
- হার্ড ড্রাইভ স্পেস পর্যবেক্ষণ করুন: ওয়ার্মের কারণে হার্ড ড্রাইভে অপ্রয়োজনীয় স্পেস খরচ হতে পারে।
ওয়ার্ম থেকে সুরক্ষিত থাকার উপায়
- মজবুত ইন্টারনেট সিকিউরিটি সফটওয়্যার ব্যবহার করুন: ফিশিং, স্পাইওয়্যার, ম্যালওয়্যার ইত্যাদি সাইবার হুমকি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শক্তিশালী এন্টিভাইরাস ব্যবহার করুন।
- ফিশিং এড়িয়ে চলুন: অজানা ইমেইল থেকে আসা সন্দেহজনক সংযুক্তি বা লিঙ্কে ক্লিক করার আগে সতর্ক থাকুন।
- অপারেটিং সিস্টেম আপডেট রাখুন: আপডেট থাকা অপারেটিং সিস্টেম ম্যালওয়্যার থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।
ওয়ার্ম, ভাইরাস এবং ট্রোজান হর্সের মধ্যে পার্থক্য
একটি ভাইরাস ফাইল বা প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত হয়ে ছড়ায়, কিন্তু ওয়ার্ম একা একাই ছড়াতে পারে। অন্যদিকে, ট্রোজান হর্স বৈধ প্রোগ্রামের মতো মনে হয়, তবে চালানোর পর ক্ষতি করে এবং ব্যাকডোর তৈরি করে, যা হ্যাকারদের জন্য প্রবেশপথ তৈরি করে।
এতক্ষন যাবত আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আজ এ পর্যন্তই, অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে আরো জানতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন আমাদের সাইবার সিকিউরিটি পেইজে। আরো বিস্তারিত জানতে উইকিপিডিয়া।
কমেন্ট করুন